দুই বাংলার জনপ্রিয় কবি সুবোধ সরকার। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, মানবিকতা, যা কখনও শ্লেষাত্মক, কখনও সরাসরি ও সংবেদনশীল। কিন্তু এত তীক্ষ্ণ, তীব্র তার ভাষা! প্রখর রাজনৈতিক চেতনায় জারিত সুবোধের কবিতা।
থানা, পুলিশ, মন্ত্রী, কেবিনেট নিয়েও তিনি শাণিত বক্তব্য রেখেছেন কবিতায়। কিন্তু সহজ-সরল ভাষায় মোক্ষম কথাটি বলেন অকপটে। তার সেই অকপট ভঙ্গিটাই বেশ উপভোগ করার মতো। যিনি টানাগদ্যে যেমন লিখছেন, তেমনি ছন্দ-অন্ত্যমিলেও। তার কবিতা যেন সবকিছু ছাপিয়ে কাহিনি কিংবা রূপকগল্পের ভেতর দিয়ে জ্বেলে দেয় সুন্দরের আশ্চর্য বিভা। কেবল অলঙ্কার প্রয়োগে নয়, সুবোধ সরাসরিও বলেন। চরমসত্য এমনই সাবলীল ভাষায় বলতে পারেন একমাত্র কবি সুবোধ সরকারই।
এই কবি ২০১৩ সালে সাহিত্যে স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ভারত সরকারের সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। এ পর্যন্ত তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ২৮টি। শিক্ষকতার পাশাপাশি সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের কাগজ ‘ভাষানগর’।
গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, কিচ্ছু ভালো লাগছে না। খেতে ভালো লাগছে না। ঘুমোতে ভালো লাগছে না। ঘুম থেকে উঠে ভালো লাগছে না। এই বুঝি তিনি এসে গেলেন। ঘরে ঢুকে পড়লেন। কত আর হাত ধোব। হাত ধুতে ধুতে একদিন পাগল হয়ে যাব না তো?
খ্যাতিমান এই কবি আরো বলেন, এই একটা জায়গায় আমি বেঁচে আছি। লেখা না থাকলে আমি বাঁচতে পারতাম না। যেদিন লিখতে পারি সেদিন ভালো থাকি। মনে হয় আমার পিঠে দুটো ডানা আছে। আমি উড়ে চলে যেতে পারি। পাহাড়ে যেতে পারি। মানস সরোবরে যেতে পারি। সমুদ্রের তীর গিয়ে নামতে পারি। গতকাল সকালে একটা কবিতা লিখেছি। লেখাটা শেষ করে যেই উঠে দাঁড়ালাম মনে হলো পৃথিবী থেকে করোনা চলে গেছে। এই ‘ফ্যান্টাসম্যাগোরিয়াতে’ পাঁচ মিনিট থাকলেও মন থেকে অবসাদ মুছে যায়। লেখা থেকে এরকম একটা দারুচিনির গন্ধ পাই আমি। সেটা বেশিক্ষণ থাকে না। নাই বা থাকলো। যতক্ষণ থাকে ততটাই ষোলআনা।
তিনি আরো বলেন, মহাভারত পড়ছি আবার। সঙ্গে গার্সিয়া মার্কেজ। আ ডেডলি কমবিনেশন। করোনার অভিঘাতে চেনা পৃথিবীর কতোটা বদল ঘটেছে? জানতে চাইলে বরেণ্যে এই কবি বলেন, বদল?
পৃথিবীর ওপিঠে এসে পড়েছি আমরা। এই পৃথিবীকে আমরা আগে দেখিনি। লকডাউনের আগে পৃথিবীকে যেখানে রেখে এসেছি সেখানে ফিরে গিয়ে আর আমরা তাকে পাব না। সারাক্ষণ আমাদের নস্টালজিয়া হবে। আহা আমরা আগে কি সুন্দর কফি হাউসে বসে আড্ডা দিতাম। আহা কি সুন্দর জামাইষষ্ঠী হত। কি ভালো ছিল ঈদের আনন্দ, পুজোর হইচই। এসব নিয়ে আমরা স্মৃতিকথা লিখবো। ছোটরা জানতে চাইবে ব্রিগেডে কত লোক হতো। আমরা বলবো দশ লক্ষ লোক হতো জনসভায়। ছোটরা বলবে, গুল মারছে, এদের এখন একটাই স্বভাব গুল মারা। আমরা নিউনরম্যালকে নিতে পারব না আবার নস্টালজিয়ায় ভেসে যেতেও পারব না। আমরা একটা চিরন্তন দ্বিধায়, একটা ইটারনাল ডিলেমায় আটকে থাকব।
করোনার এই সময়টাকে কেউ কেউ যুদ্ধ বলছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুদ্ধের সময় আপনি পালাতে পারেন। এখন আপনি পালাতে পারবেন না। পালিয়ে যাবেন কোথায়? জলপথ বন্ধ। স্থলপথ বন্ধ। আকাশপথ বন্ধ। কোনো দেশ আপনাকে নেবে না। কোনো দেশ আপনাকে যেতেও দেবে না। আপনি যেখানে আছেন, যে পাড়ায় আছেন, যে আবাসনে আছেন, সেখানেই থাকতে হবে। আপনি এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় গিয়ে ঘুরঘুর করলে পুলিশ আপনাকে সন্দেহ করবে।