বিশ্বজাহানের মহান স্রষ্টা মহাপরাক্রমশালী পরম দয়ালু প্রতিপালক আল্লাহ্তায়ালার প্রশংসা লিখিতে গিয়া যদি সাগরের পানি কালি হিসাবে ব্যবহার করা হয় তাহা হইলে সাগরের পানি নিঃশেষ হইয়া যাইবে কিন্তু মহান প্রভুর গুণের প্রশস্তি শেষ হইবে না।
সেই মহান প্রভুর প্রিয় সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা এই মানবজাতি। মানবজাতিকে মহান আল্লাহ্তায়ালা সৃজন করিবেন তাহা জানিতে পারিয়া ফেরেস্তাগণ উহাতে সংশয় প্রকাশ করিলেন। অথচ মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁহার প্রিয় হাবীব মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে মহাকাল পূর্বেই সৃজন করিয়া রাখিয়াছিলেন। তাই অনেক কিছুই মহান প্রতিপালকের পূর্বসৃষ্টি এবংআগাম নির্ধারিত। তাই নবী-রাসূল ও অলী-আউলিয়াকেও মহান আল্লাহ্তায়ালা পূর্বেই রূহ সৃষ্টি করিবার সময় মর্যাদাবান করিয়া সৃজন করিয়াছেন। তাই তাঁহারা মানবমন্ডলীর মধ্যে নক্ষত্রতুল্য। এই জন্যই উহারা বিপদ-আপদ ও আগুন-পানির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। কোনো কিছুতেই তাঁহারা দ্বিধা-বিচলিত হন না। কখনো সংশয়বিদ্ধ কিম্বা হতাশাগ্রস্ত হন না।
এ প্রেক্ষিতে সাধারণ মানুষের জন্যও আশার বাণী রহিয়াছে। তাহা হইতেছে এই যে, কেহ যদি খাঁটি অলীর সংসর্গে থাকিয়া সাধনা করেন তবে মহান আল্লাহ্তায়ালা সন্তুষ্ট হইলে তাহাকেও অলীর মর্যাদা দান করিতে পারেন। কারণ মহান আল্লাহ্তায়ালা কুদরতের আধার এবং সর্বৈব ক্ষমতার অধিকারী। তাঁহার ইচ্ছা হইলে তিনি সব কিছুই করিতে পারেন। তিনি কোনো কিছুরই পরোয়া করেন না। তাই তিনি যাহাকে খুশি মর্যাদা দান করিতে পারেন। আবার যাহাকে ইচ্ছা মর্যাদার আসন হইতে অপসারণ করিতে পারেন। তাই সাধারণ মানুষের পক্ষেও আধ্যাত্ম সাধনার মাধ্যমে অলীর মর্যাদা অর্জন করা সম্ভব। ইহাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নাই।
মহান আল্লাহর অলীগণ যখন আল্লাহময় ভাবাবেশে আচ্ছন্ন থাকেন তখন তিনি যাহা ইচ্ছা করিবেন তাহাই সংঘটিত হইবে। কারণ তখন তিনি মহান আল্লাহর কুদরতী শক্তিতে বলীয়ান থাকেন। তাই সর্বদাই কামেল অলীর সুনজরে থাকিয়া ইহলোক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধন করাই হচ্ছে দুনিয়ার মানবমণ্ডলীর জন্য উত্তম কর্ম। তবে মহান অলীগণের সঙ্গে কোনোরূপ আদবের খেলাপ করা অত্যন্ত অমঙ্গলজনক কাজ।
জগতে অনেক মানুষ আছেন যাহারা অজ্ঞতাহেতু মহান আল্লাহর অলীগণের প্রতি ঢালাওভাবে বিদ্রূপাত্মক মনোভাব প্রকাশ করেন। মহান আল্লাহতায়ালা ইহাতে অসন্তুষ্ট হইলে তাহাকে গজবে নিপতিত হইতে হবে। যাহাকে রক্ষা করিবার আর কোনো উসিলা কাজে আসিবে না। তাই মহান অলীগণের বিষয়ে না জানিয়া কোনো কিছু বলা মোটেই বাঞ্ছনীয় নহে। কামেল আউলিয়ার প্রতি অগাধ বিশ্বাস-ভালোবাসা পোষণ করলে ইহা হতে পারে আমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি উসিলা।
শুভ জন্মলগ্ন
মহান আল্লাহ্তায়ালা রাব্বুল আলামীন আত্মভোলা পথহারা পাপিতাপী মানুষকে সহজ-সরল পথ দেখাইবার জন্য এবং তাঁহার মাহাত্ম্য জগতে প্রকাশ করিবার অভিপ্রায়ে কালের পরিক্রমায় তাঁহার প্রতিনিধি তথা নবী-রাসূল ও অলী-আউলিয়াকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ করিয়া থাকেন।
নবুয়তের ধারা সমাপ্ত হইবার পর গোমরাহ অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষদিগকে ঐশ্বী আলোর দিশা দিবার জন্য মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁহার প্রিয় বন্ধু তথা অলী-আউলিয়াকে পৃথিবীতে প্রেরণের ধারা অব্যাহত রাখিয়াছেন।
মহান আল্লাহ্তায়ালা এই বন্ধুত্বের ধারায় এক শুভক্ষণে তাঁহার অলীকে পৃথিবীতে প্রেরণ করিয়াছেন।
হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) ১২৬০ বঙ্গাব্দে বর্তমান পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলা অন্তর্গত কারখানা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতা সুফি সাধক মোহাম্মদ রজ্জব আলী হাওলাদার (রহ.) এবং মাতা মোসাম্মাৎ মেহের নেগার বেগম (রহ.)। দুই ভ্রাতা ও দুই ভগ্নির মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ।
এই মহান অলী তাঁহার সমস্ত জীবন অতিবাহিত করিয়াছেন আধ্যাত্ম সাধনা ও ইসলামী গবেষণায়। উপমহাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত মুসলিম তীর্থস্থানসমূহ তিনি ভ্রমণ করিয়াছেন। মক্কা-মদিনাসহ আরবের বিভিন্ন দেশে সমাহিত নবী-রাসূল ও অলী-আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করেন এবং তাঁহাদের শিক্ষা অনুসরণ ও গবেষণা করিয়া তাহা বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি জীবনে বহুবার হজ্বব্রত পালন করিয়াছেন।
তাঁহার ভাবাবেগ ও ঐশীপ্রেম তাহাকে সমস্ত জীবন কঠোর সাধানার পথে নিত্যনিয়ত রাখিয়াছিল। দুনিয়ার কোনো স্বার্থ কিম্বা মায়ামোহ কখনোই তাঁহাকে আবিষ্ট করিতে পারে নাই। সাধক পিতার কাছে তিনি শৈশবেই যে ঐশী আলোর দিশা পাইয়াছিলেন তাঁহাতে স্বীয় অন্তরজগৎকে আলোকিত করিয়াছিলেন। জগৎময় পঙ্কিলতা জীবনের কোনো বাঁকেই তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই।
তিনি যোগ্য পিতার সুযোগ্য সন্তান হিসাবে নিজেকে আদর্শ মানবরূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। পারিবারিক প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও তিনি কখনোই উহাতে গা ভাসাইতেন না। সামাজিক মর্যাদায়ও কখনো অহম বোধ করিতেন না। ঐশ্বরিক উপলব্ধি তাঁহার ভাবাবেশকে সর্বদাই আকুল ও প্রসন্ন করিয়া রাখিত।
বংশ পরিচয়
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) বংশগত সূত্রে ছিলেন হাওলাদার। তাহার পিতা সুফি সাধক মোহাম্মদ রজ্জব আলী (রহ.) ব্রিটিশ সরকারের নিকট হইতে অত্র অঞ্চলে হাওলা ক্রয়পূর্বক নিষ্কর ভূমির অধিকারী হন। উহাতে তাঁহারা বসবাস শুরু করেন এবং নতুন বসতি স্থাপন ও আবাদের নিমিত্তে কিছু কিছু ভূমি প্রজাদের মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দান করেন। নিজ বাড়িতে একটি কাছারি নির্মাণ করিয়া তথায় নায়েবসহ কিছু রাজস্ব কর্মচারী নিয়োগ করেন এবং উহাদের মাধ্যমে প্রজাদিগের নিকট হইতে খাজনা গ্রহণ করিতেন। শাহের ভ্রাতুষ্পুত্রী কারী নূরবানু বেগম কাছারিগৃহ এবং একজন বৃদ্ধ হিন্দু নায়েবকে প্রত্যক্ষ করিবার বর্ণনা দিয়াছেন।
এই মহান অলীর নথিভুক্ত নাম ছিল মোহাম্মদ নূরুজ্জামাল হাওলাদার। তিনি স্থানীয় জনসাধারণের নিকট ‘দরবান মুন্সি’ নামে অধিক পরিচিত ছিলেন। ভক্তগণ তাঁহাকে দরবান শাহ (রহ.) বলেই বেশি উল্লেখ করে থাকেন। এই সাধকের জীবনকালে ইসলামী ভাবধারার অনুসারী ব্যক্তিগণ তাহাকে ‘সুফি সাব’ বলিয়া উল্লেখ করিতেন।
পারিবারিক সূত্রের বিভিন্ন বর্ণনা হইতে জানা যায়, তাঁহাদের পূর্বপুরুষগণ সুদূর আরব অঞ্চলের কোনো দেশ হইতে এই বঙ্গীয় অঞ্চলে আগমন করিয়াছিলেন। ইসলাম প্রচার করিতে আসিয়া এই অঞ্চলটি তাঁহাদের ভালো লাগিয়া যায়। তাই তাঁহারা ব্রিটিশ সরকারের নিকট হইতে হাওলা ক্রয়পূর্বক স্থায়ী বসতবাড়ি নির্মাণ করেন।
পিতা-মাতার পরিচয়
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর পিতা সুফি সাধক হযরত রজ্জব আলী (রহ.)-ও একজন কামেল ওলি ছিলেন। তিনি মহান আল্লাহর নিকট সুসন্তান প্রার্থনা করেন। শুভক্ষণে মহান আল্লাহ তাঁকে পুত্রসন্তান দান করেন।
রজ্জব আলী (রহ.) স্বীয় জ্যৈষ্ঠপুত্র হযরত নূরুজামাল (রহ.)-কে দীনিশিক্ষা ও আধ্যত্ম সাধনায় দীক্ষিত করেন। মহান আল্লাহর নিকট তিনি প্রার্থনা করেন- প্রিয়পুত্র যেন আধ্যত্ম সাধনায় ব্রতী হইয়া বিশুদ্ধচিত্তে মহান প্রভুর নৈকট্য লাভ করতে সমর্থ হন।
দরবান শাহ্ (রহ.)-এর পিতাই ছিলেন তাঁহার পরম গুরু। পরবর্তীতে তিনি দেশ-বিদেশের বহু কামেল অলীর সংসর্গ লাভ করেন।
দরবান শাহ্ (রহ.)-এর মাতা মোসাম্মাৎ মেহের নেগার বেগম ছিলেন কারখানা গ্রামের সম্ভ্রান্ত আখন্দ পরিবারের সুযোগ্য কন্যা।
উল্লেখ্য যে, আখন্দ পরিবারও পূর্ব হইতে বংশপরম্পরায় শিক্ষিত ছিল।
দৈহিক ভূষণ
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) ছিলেন মাঝারী গড়নের সুদর্শন কমনীয় কান্তিময় চমৎকার গুণাবলী সম্বলিত এক আদর্শ মানব। তাঁহার গায়ের বর্ণ ছিল ফর্সা ও দীপ্তিময়। তাঁহার চেহারা ছিল শাণিত, দৃঢ় ও অসাধারণ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। পহেলা দর্শনেই মনে হইত তিনি এক মহানুভব মনীষী। সকল মানবীয় গুণাবলীর সমাহারে তৎকালে তিনি ছিলেন অনন্য।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) ছিলেন একজন সুফি সাধকের সন্তান। তাই শৈশব হইতেই দীনিশিক্ষা গ্রহণসহ সমাজ, সংস্কৃতি এবং আধ্যাত্ম্য সাধনায় স্বীয় চারিত্রিক গুণাবলীকে উত্তমরূপে শানিত করেন। তিনি মানুষের কল্যাণে এবং খোদাপ্রেমে ছিলেন কঠোর ত্যাগী।
তাঁহার সমসাময়িক এবং পূর্বাপর অনেক পীর মাশায়েখের উদ্ভব ঘটিয়াছিল। যাহাদের অনেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিবার জন্য পালকি অথবা মুরিদের কোলে কিংবা কাঁধে আরোহণ করিতেন। কেহ কেহ শরীর ও হস্ত-পদ মর্দন করাইতেন।
এই দিক হইতে দরবান শাহ্ (রহ.) ছিলেন ভিন্ন। তাঁহার চারিত্রিক গুণাবলী ছিল অপরিসীম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত উপমা। তিনি ওই কাজগুলিকে ভীষণ অপছন্দ করিতেন। একজন মহামানবের যেইসব গুণাবলীর বৈশিষ্ট্য থাকে ইহার পরিপূর্ণ উপস্থিতি তাঁহার মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
তিনি একশত পাঁচ বৎসরের পরম আয়ু লাভ করিয়াছিলেন। অথচ বার্ধক্যেও তিনি ছিলেন পরিমার্জিত রুচিবোধের অধিকারী।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, দরবান শাহের ভ্রাতুষ্পুত্রগণকে পড়াইবার জন্য একজন সুশিক্ষিত পন্ডিত গৃহশিক্ষক নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বার্ধক্যে উপনীত হইবার পর হাঁটাচলা করিতে পারিতেন না। তাই তাহাকে কোলে লইয়া বাড়িতে আনা-নেওয়া করা হইত। বিষয়টি দরবান শাহ (রহ.)-এর আদর্শের সহিত বৈপরিত্যপূর্ণ হওয়ায় একদিন সিদ্ধান্ত হইল- চার চাকাওয়ালা একটি চেয়ার বানানো হইবে। তদানুসারে চার চাকাবিশিষ্ট একটি কাঠের কেদারা তৈয়ার করা হইল এবং ওই কেদারায় উপবেশন করাইয়া সম্মানিত শিক্ষককে বাড়িতে আনা-নেওয়া করা হইত।
কালক্রমে শিক্ষক গত হইয়াছেন। তাঁহার চেয়ারটিও দিনে দিনে ভাঙ্গিয়া যাইতে লাগিল। সর্বশেষ দুইটি চাকা লইয়া এই লেখক শৈশবে খেলিয়াছেন।
দরবান শাহ্ (রহ.)-এর কোনো কোনো অনুসারী ভক্তির আতিশয্যে এমন কোনো কাজ করিতেন- যাহাতে তিনি রাগান্বিত হইতেন। নিজের শারীরিক সামর্থ্য থাকা পর্যন্ত তিনি কাহারো কোনোরূপ সেবা গ্রহণ করিতেন না।
শৃঙ্খলাবোধ
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) কঠিন আধ্যাত্ম সাধনা ও সুশৃঙ্খল জীবন-যাপন করিতেন। অহেতুক কথা বলিতেন না। অনিন্দ্য রুচিশীল সুন্নতি পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করিতেন। অনুষ্ঠানাদি তথা যাবতীয় কাজ-কর্মে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা বিধান করিতেন। খাবার হইতে শুরু করিয়া সকল কাজেই কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা পালন করিতেন। তাঁহার সম্মুখে খাবার সাজানো হইলে ইহারও সুনির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকিত। ভাতের গামলা, তরকারির বাটি, পানির গ্লাস, উচ্ছিষ্টের বাটি- সব মিলাইয়া কোন পাশে কোনটি রাখা হইবে ইহারও একটি অলিখিত সুন্দরতম ছক থাকিত। অনুসারীগণও অতি সন্তর্পণে এই সকল নিয়ম-শৃঙ্খলা পালন করিতেন। যাহাতে নিহিত ছিল সামাজিক সুশৃঙ্খলার সুন্দরতম নিদর্শন।
সামাজিক শৃঙ্খলাবোধ, ইসলামী ভাবাদর্শ, রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান এবং মানবিক মূল্যবোধে পরিচালিত হওয়ার কারণে সমকালীন সাধকগণের মধ্যে তিনি ছিলেন অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। তাই সর্বস্তরের মানুষ তাহাকে গভীর শ্রদ্ধা করিতেন।
নান্দনিক রুচিবোধ
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) ছিলেন নান্দনিক অনুসরণীয় রুচিবোধের অধিকারী। দীপ্ত প্রাণবন্ত মুচকি হাসি, পরিপাটি পোশাক-পরিচ্ছদ, পরিমিত আহার ও মিতভাষীতাসহ মানবীয় সকল গুণাবলীর সমাহার মহান আল্লাহ্ তাঁহাকে দান করিয়াছিলেন।
নিভৃত নিবিড়ে তিনি ধেয়ানে নিমগ্ন হইতেন এবং লোকসাক্ষাতে ফুরফুরে মেজাজ আর বেশ-ভূষণ তাহার ভাবাবেশকে প্রচ্ছন্ন করিয়া রাখিত।
পোশাক-পরিচ্ছদ ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নুরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) অত্যন্ত রুচিশীল সুন্নতী পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করিতেন। পাজামা-পাঞ্জাবি, টুপি ও পাগড়ি ছিল তাহার নিত্য স্বাভাবিক পরিধেয়।
তিনি খাবার-দাবারে বেশিরভাগ মৃৎপাত্র তথা মাটির তৈজসপত্র ব্যবহার করিতেন। পানি পান করিতেন একটি পিতলের গ্লাসে। খাবার শেষে মাটির বাসনেও পানি পান করিতেন। একটি নকশাবিহীন খাটে নিদ্রা যাইতেন। শেষ বয়সে হুজরার মেঝেতে উঁচু করা জায়গায় শুইতেন। বার্ধক্যে তিনি একটি ছড়ি ব্যবহার করিতেন। পিতলের একটি অপেক্ষাকৃত বড় আকারের বদনা দ্বারা অজু করিতেন। কাঠের তৈরি খড়ম পায়ে পরিধান করিতেন।
দরবান শাহ (রহ.)-এর দরবারে সুদৃশ্য মোমদানি দ্বারা আলোকসজ্জিত করা হইত। পিতলনির্মিত বড় আকারের চেরাগ দ্বারাও পারিপার্শিক আলোর ব্যবস্থা করা হইত। প্রয়োজন অনুসারে অধিক আলোর ব্যবস্থাও থাকিত। কয়েক শাখাবিশিষ্ট একটি হারিণের শিংয়ের সাথে নামাজের মাদুর টাঙিয়ে রাখা হইত। শাহের পারিবারিক সূত্র জানায়, এই শিংটি তাঁহার পূর্বপুরুষের শিকার করা হরিণের শিং।
প্রাত্যহিক আহার্য
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) সকল ধরনের হালাল আহার্যই গ্রহণ করিতেন। তাঁহার খাবারে ছিল সুষম মার্জিত রুচিশীলতার পরিচয়।
কোনো খাবারে উপকরণ ও প্রণালীর ব্যতিক্রম ঘটিলে তিনি তাহা বুঝিতে পারিতেন এবং উহা স্বল্প পরিমাণে গ্রহণ করিতেন।
খাবারের জন্য যাহাকিছুই থাকিত- সর্বশেষে তিনি মিষ্টান্ন গ্রহণ করিতেন। তাই দুধ, কলা বা আখের গুড় ছিল খাবারের নিত্য তালিকায়।
সকালের নাস্তা
মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.) প্রত্যুষে ৪টি রুটি দ্বারা নাস্তা করিতেন। কোনো অভ্যাগত কিম্বা পরিবারের কেহ তখন হুজরায় প্রবেশ করিলে তিনি তাহাকে একটি রুটি দিতেন। এমনকি চারজন অভ্যাগত হইলে ৪টি রুটিই চারজনকে দিয়া দিতেন। নিজের খাবার অপরকে বিলাইয়া দিতে পারিয়া মানসপটে তিনি অপরিসীম পরিতুষ্টি লাভ করিতেন। আল্লাহর অলী দুনিয়া ও আখেরাতের ধনী। তিনি ইচ্ছা করিলে ফলফলাদি অথবা অন্য কোনো হালকা খাবার গ্রহণ করিতেন। নতুবা পরবর্তী বেলার খাবার পর্যন্ত প্রসন্ন চিত্তে সময় অতিবাহিত করিতেন।
বার্ধক্যের শেষ প্রান্তে উপনীত হইবার পর সকালের নাস্তায় কিম্বা অন্যান্য সময় মুড়ির গুঁড়ার সঙ্গে আঁখের গুড় মিশাইয়া দলা তৈয়ার করিয়া গ্রহণ করিতেন।
প্রাত্যহিক নিদ্রা
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) রাত্রিকালের ইবাদত ও ফজরের নামাজ শেষে প্রত্যুষে নাস্তা সারিয়া বিছানায় যাইতেন এবং একটি সাদা চাদরের আচ্ছাদনে কয়েক ঘণ্টা নিদ্রা যাইতেন।
রাতের খাবার শেষে অল্প সময় ছাড়া প্রায় সমস্ত রাত্রিই তিনি ইবাদতের মধ্যে কাটাইতেন, তাই এইটাই ছিল তাঁহার প্রধান ঘুমের সময়।
নিদ্রা হইতে জাগিয়া তিনি অজু-গোসল করিতেন। ইহার পর পুতঃপবিত্র মনে মোরাকাবায় বসিতেন। অনুসারীগণের নালিশ শুনিতেন এবং উপদেশ বাণী প্রদান করিতেন। জোহরের সময় হইলে নামাজ আদায় করিতেন।
প্রাত্যহিক গোসল
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) মৃত্যুর দিনক্ষণ অবগত হইবার পর প্রত্যহ বরইপাতাসহ গরম পানি দ্বারা গোসল করিতেন। গোসলে তিতপোড়লের জালিকা এবং কদাচিৎ সাবান ব্যবহার করিতেন।
শাহের ভাদ্রবধূ জয়নব বিবি বরইপাতাসহ পানি গরম করিতেন। পরিবারের বধূ-কন্যাগণও বিভিন্ন রকম খিদমতে গৃহমাতা জয়নব বিবিকে সাহায্য করিতেন। তিনিই খাবার-দাবারসহ দরবান শাহ্ (রহ.)-এর প্রয়োজনীয় সব কিছু সরবরাহ করিতেন।
বার্ধক্যে তাঁহাকে গোসলে সাহায্য করিতেন পরিবারবর্গের পুরুষ সদস্যগণ এবং সফরকালে শিষ্যগণ তাঁহাকে গোসলে সাহায্য করিতেন। পরিবারের সবারই প্রধান কর্তব্য ছিল এই মহামানবের সেবায় ব্রতী থাকা।
স্ত্রী-পুত্রের ইন্তেকাল
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) বিবাহিত জীবনে এক পুত্রের জনক ছিলেন।
একদা এক ডায়রিয়া মহামারিতে দরবান শাহ্ (রহ.)-এর স্ত্রী-পুত্র ইন্তেকাল করিলেন। ইহাতে তিনি স্বজনের মায়ামুক্ত এবং সংসারের দায়মুক্ত হইলেন। এইবার সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করিলেন মহান প্রভুর ধেয়ানে।
এই শতবর্ষী মহামানব যৌবনের প্রারম্ভে স্ত্রী-পুত্রকে হারানোর পর পরিবারবর্গের লোকজন ও অনুসারীগণ তাঁহাকে অনুরোধ করিলেন, বিবাহ করিয়া পুনরায় সংসার করিতে। কিন্তু তিনি তাহাতে সম্মত হইলেন না। ভক্তগণ পূনরায় আরজ করিলেন সন্তান-সন্ততির প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি।
যিনি মহান প্রভুর অমৃত প্রেমসুধা আস্বাদন করিয়াছেন তিনি কেমন করিয়া নশ্বর পৃথিবীর মোহজালে নিজেকে আবিষ্ট করিবেন? তিনি শুধাইলেন- ‘আল্লাহ্ ইহা চাহেন না।’ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তিনি অপেক্ষাকৃত উত্তম পন্থাই অবলম্বন করিয়াছিলেন।
পারিবারিক ঔশ্বর্যকে তিনি কখনও পুঁজি করিতেন না। ধন-সম্পদের বিষয়েও তিনি ছিলেন নিষ্পৃহ। তথাপি তিনি কখনও উদাস ছিলেন না। আধ্যাত্মিক চেতনা ও জীবনবোধে সর্বদা সজাগ ছিলেন।
নির্লোভ-নির্মোহ এই সাধক একাগ্র চিত্তে মহান প্রভুর ধেয়ানে নিমগ্ন থাকিতেন। কোনোরূপ সংশয়-সঙ্কোচ তাঁহাকে কখনো দ্বিধা-বিচলিত করে নাই। তিনি ছিলেন শান্ত-স্নিগ্ধ অটল প্রত্যয়ী একনিষ্ঠ সাধক।
দরবান শাহ্ (রহ.)-এর দীর্ঘদিনের সতীর্থ সাধকগণও এক সময় তাঁহার হস্তে বায়েত গ্রহণ করিয়াছিলেন পরম শ্রদ্ধায়।
আলেম-ওলামাসহ বহু বিশিষ্টজন ও পণ্ডিত ব্যক্তিগণ তাঁহার মুরিদান এবং অনুসারী ছিলেন।
নিভৃতচারী সাধক
মহান আল্লাহ্তায়ালার প্রিয় হাবীব হযরত মোহাম্মদ (স.)-এর অনুসৃত পথে এই সাধক তাঁহার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করিয়া গিয়াছেন।
নূরে মোহাম্মদীর ধারক-বাহক হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান শাহ্ (রহ.) কখনও কোনোরূপ ঔশ্বর্য কিংবা আত্মযৌলুস প্রকাশ করিতেন না। আবার কোনো কিছু গোপনও করিতেন না। তাঁহার কোনোরূপ যৌলুস দ্বারা তাঁহার ব্যক্তিত্বকে কেহ প্রভাবিত করিতে চাহিলে তিনি তাহাকে বারণ করিতেন।
তিনি জীবনে বহুবার হজ্বব্রত পালন করিয়াছেন। তথাপি ‘হাজী’ পরিচয় প্রকাশ কিম্বা হাজী লিখতে বা সম্বোধন করিতে অনুসারীগণকে নিষেধ করিতেন। কারণ কোনোরূপ লকব বা উপাধি অলঙ্কারে মানুষের আত্মঅহমিকা বাড়িয়া যায়। পূণ্যের পথে বিঘ্ন ঘটায় এবং সর্বোপরি সাধনার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।
আত্মঅহমিকা বা কোনোরূপ অহঙ্কার হইতে সর্বদা নিজেকে মুক্ত রাখিতেন। কোনো প্রকার উপাধি বা লকব দ্বারা তাহার নামকে যেন অলঙ্কৃত করা না হয় সেই দিকেও তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখিতেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বক্ষমান গ্রন্থে তাঁহার নামের সহিত যেইসব লকব বা উপাধি রহিয়াছে উহা তাঁহার মৃত্যুর পর শীর্ষ অনুসারীগণ তাঁহার নামের সহিত ব্যবহার করিতেন। তাই বিষয়টি যৌক্তিক বিবেচনায় লেখক উহা গ্রহণপূর্বক গ্রন্থনা করিয়াছেন।
এই মহান সাধকের জীবনকালে তাঁহার অনুসারীগণ অনেক অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। এই বিষয়ে তাহারা আলোচনা করিলে তিনি তাহাও বারণ করিতেন।
নির্লোভ-নির্মোহ এই সাধক ধর্মীয় শিক্ষা দিতেন এবং নিবিষ্ট চিত্তে মহান আল্লাহ্তায়ালার ইবাদত করিতেন। কখনো মুরিদ বাড়াইবার মানসে কোনোরূপ প্রচার করিতেন না। কেহ মুরিদ হইতে চাহিলে তিনি তাহাকে মুরিদ করিতেন। অর্থ-সম্পদের প্রতিও তাহার কোনোরূপ অভিরুচি ছিল না। বহু কামেল সাধক ও বিশিষ্ট আলেমগণ তাঁহার অনুসারী ছিলেন।
কাজের শুরুতেই দোয়া পাঠ
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) ছিলেন একনিষ্ঠ সাধক। প্রভুপ্রেম সদাই তাঁহাকে আবিষ্ট করিয়া রাখিত।
তিনি খেতে-পড়তে, চলতে-বলতে সকল কাজেই দোয়া পাঠ করিতেন। সর্বদাই মহান আল্লাহ্কে স্মরণ করিতেন এবং নীরব জ্বিকিরে মশগুল থাকিতেন। কাহারও সহিত কথা বলিতেও মহান আল্লাহ্কে স্মরণ করিয়া লইতেন। মনে হইত মহান প্রভুর উপস্থিতি এবং ইচ্ছায়ই তিনি কথা বলিতেছেন। তাই ভক্তগণ তাঁহার উপদেশাবলী পুঙ্খানুপুঙ্খ শ্রবণ করিয়া তাহা প্রাণপণে পালন করিতেন।
শিক্ষা পদ্ধতি
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) ইসলামের প্রধানত চারটি বিষয়ের উপর শিষ্যদের দীক্ষা দিতেন। যেমন- শরিয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাত।
ইসলামের এই চারটি বিষয়ের প্রতিটির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব রহিয়াছে। ইহার কোনোটি বাদ দিয়া পরিপূর্ণ ইবাদত কিম্বা মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা সম্ভব নহে।
সিলসিলা
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) পরিপূর্ণ ইসলামী ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত প্রধান চার তরীকার দীক্ষা গ্রহণ করেন।
সিলসিলার ধারায় তিনি মাইজভান্ডারী (রহ.)-এর দীক্ষায় বেশি প্রভাবিত ছিলেন।
তিনি মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রহ.)-এর মোজাদ্দেদীয়া তরিকা, বাহাউদ্দিন নকশবন্দ (রহ.)-এর নকশবন্দিয়া তরিকা, মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর কাদরিয়া তরিকা এবং খাজা মাঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর চিশতিয়া তরিকার দীক্ষা অনুসরণ করেন।
তিনি তাঁহার প্রিয় মুর্শিদ সাধকপ্রবর এঙ্গোল মোল্লা (রহ.)-সহ দেশ-বিদেশের অনেক কামেল অলীর সান্নিধ্য লাভ করিয়া স্বীয় আত্মার জগৎকে সমৃদ্ধশালী করিয়াছিলেন।
দরবান শাহ্ (রহ.) যেমনি একাগ্রচিত্তে প্রভুপ্রেমের ধেয়ান-মোরাকাবা করিতেন। তেমনি প্রবল জ্ঞানপিপাসাও ছিল তাঁহার। তিনি কোরআন-হাদীসের গবেষণা করিতেন এবং তৎকালে পৃথিবীর বহু দেশের বুজুর্গ ব্যক্তির সংসর্গে গিয়া স্বীয় জ্ঞানের পরিধিকে আরো প্রসারিত করেন।
তিনি শুধুমাত্র একজন মুর্শিদের বা একজন শিক্ষকেরই দীক্ষা গ্রহণ করিতে হইবে- এমন বাধ্যবাধকতা মনে করিতেন না। তাই তিনি বিশুদ্ধ জ্ঞান অন্বেষণ করিবার অভিপ্রায়ে দেশ-দেশান্তরে ছুটিয়াছেন এবং ইসলামি সাধক বুজুর্গ পণ্ডিতগণের সাহচর্য লাভ করিয়াছিলেন।
পালনীয় অনুষ্ঠানসমূহ
প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স.)-এর জন্ম দিবসে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স.) অনুষ্ঠান পালনের জন্য দরবান শাহ্ (রহ.) বড় মাহফিলের আয়োজন করিতেন। মুরিদানসহ বহু ধর্মপ্রাণ মানুষ উহাতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করিতেন।
বড়পীর হযরত মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর ওফাত দিবসেও বড় মাহফিলের আয়োজন করা হইত।
ফাতেহা ইয়াজদাহুম ও ফাতেহা দোয়াজদাহুম (ফাতেহা শরীফ) পালন করিতেন।
উহা ছাড়াও পবিত্র আশুরা এবং ১২ চান্দের ফজিলতপূর্ণ দিনে মাসিক একটি বড় মাহফিল অনুষ্ঠিত হইত।
বার চান্দের ফজিলতপূর্ণ দিনে বর্তমানেও প্রতি মাসে মাসিক মাহফিল অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে।
হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর দরবারে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে ওয়াজ-নসিহত, জ্বিকির-আজকার ও মোরাকাবা হইত। তাঁহার মুরিদানবৃন্দ ভক্তিমূলক সংগীতও পরিবেশন করিতেন।
বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে আগতদিগকে আপ্যায়ন বা তাবারুক পরিবেশন করা হইত। ইহাতে সাধারণতঃ গরুর গোশত, ডাল ও ভাতের ব্যবস্থা থাকিত।
শাহের অন্তর্ধানের পরবর্তীকালে উত্তরসুরিগণ গুড়ের সিরনি তাবারুক হিসেবে পরিবেশন করিতেন।
মাহফিলের খাদ্যসামগ্রী রন্ধনকার্য ও পরিবেশনসহ অনেক কাজই সম্পাদন করিতেন শাহের শিষ্যগণ।
মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.)-এর দরবারের অনেক রকম খাদেম ছিলেন। যাহারা সমস্ত বৎসর ধরিয়া বিভিন্ন রকম খিদমতে শামিল থাকিতেন। তাহাদের মধ্যে এমন কেহ কেহ ছিলেন যাহারা সৌখিন বড় তালপাতার আস্ত পাখা বানাইতেন এবং সভার মধ্যমণি প্রিয় মুর্শিদকে বাতাস করিতেন।
ইসলামী গবেষণা
মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.)-এর ছিল অগাধ পান্ডিত্ব। আরবী, ফার্সি ও উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষায় তাঁহার পারদর্শিতা ছিল। হরকতবিহীন আরবী ভাষা লিখিতে, পড়িতে ও বুঝিতে পারিতেন। তিনি পবিত্র কোরআন-হাদীস এবং নবী-রাসূলগণ ও অলী-আউলিয়া প্রদত্ত শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা করিয়া তাহা বাংলায় অনুবাদ করিতেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সুদূর অতীত হইতে দরবান শাহ (রহ.)-এর পূর্বপুরুষগণ বংশ পরম্পরায় শিক্ষিত ছিলেন এবং তাঁহারা ইসলাম প্রচার ও সাধনা করিতেন।
মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.) আরব বিশ্ব এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে নবী-রাসূলগণ ও অলী-আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করিয়াছেন। মহামনিষীগণের শিক্ষা ও জীবনাদর্শ অনুসন্ধান করিয়া তাহা বাংলায় গ্রন্থনা করিতেন।
এই সাধক ডবল ডিমাই কাগজ এক ভাঁজ করা টেবিল আকারের বড় বহির ভিতর তাঁহার সমস্ত জীবনের গবেষণালব্ধ বিষয় লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।
ইসলামী দীক্ষা প্রদান
বঙ্গোপসাগরের পলিগঠিত প্রকৃতির লীলাভূমি তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলা (বর্তমানে বৃহত্তর বরিশাল)-এর দক্ষিণ ভাগের উপকূলজুড়ে বিরাট জনপদ গড়িয়া ওঠে। এই সব জনপদের মানুষকে ধর্মীয় আলোয় উদ্ভাসিত করিবার জন্য মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.) বিভিন্ন অঞ্চল, দ্বীপ-দ্বীপান্তর সফর করিয়াছেন। অসংখ্য মানুষকে ধর্মীয় দীক্ষায় উদ্দীপিত এবং দীক্ষিত করিয়াছেন।
তিনি অনাড়ম্বর অথচ সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করিতেন। তাঁহার ঐশ্বীপ্রেমের সাধনা সর্বদা তাঁহার ভাবাবেশকে আলোড়িত করিয়া রাখিত। অনুসারী সাধকগণের মধ্যে তিনি ছিলেন নক্ষত্রতুল্য। ভক্ত সাধকগণ সর্বদাই তাহাকে ঘিরিয়া থাকিতেন। দরবান শাহ (রহ.)-এর অনুসারী সাধকগণের মধ্যে অনেকেই কামেল অলী ছিলেন। ইহার প্রমাণ মেলে তাহাদের প্রদত্ত বহু ঘটনার পূর্বাভাস থেকে।
বিভিন্ন শ্রেণির সাধক
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর দরবারে বিভিন্ন শ্রেণির অনুসারী লক্ষ্য করা যাইত। তাহাদের মধ্যে দুই শ্রেণীর সাধক বেশি লক্ষ্য করা যাইত। তাহারা হইলেন হাদী ও মাজ্জুব শ্রেণির সাধক।
হাদী শ্রেণির সাধকগণ ওয়াজ-নসিহত, মিলাদ-মাহফিল, মোরাকাবা ও নামাজ আদায় করিতেন এবং পরিপূর্ণ সামাজিক জীবন-যাপন করিতেন। আর মাজ্জুব শ্রেণির সাধকগণ মিলাদ-মাহফিল, হালকায়ে জ্বিকির, মোরাকাবা এবং নামাজ পড়িতেন। তাঁহারা মোরাকাবায় আধ্যাত্মিক বয়ান করিতেন।
সতীর্থের বায়েত গ্রহণ
দরবান শাহ (রহ.)-এর প্রিয় মুর্শিদ সাধকপ্রবর এঙ্গোল মোল্লা (রহ.)-এর মৃত্যুর পর তাঁহারই নির্দেশ মোতাবেক মুরিদগণ দরবান শাহের নিকট বায়েত গ্রহণ করেন। তাহাদিগের মধ্যে কারখানা গ্রামের জয়নাল মৃধা ছিলেন অন্যতম।
তিনি এইবার মুর্শিদকে পাইলেন নিজ বাড়ির আরও নিকটে। মুর্শিদকে তিনি মনে-প্রাণে ভালোবাসিয়াছিলেন। তাই আরও নিকটে পাইতে চাহিলেন।
একদা জয়নাল মৃধা নিজ বাড়িতেই মুর্শিদের জন্য হুজরা শরীফ নির্মাণ করিলেন। ভক্তের নিখাদ ভালোবাসা মুর্শিদের প্রাণে ধরিল। তিনি তথায় সাগ্রহে অবস্থান গ্রহণ করিলেন।
প্রিয় সাধক যেন স্ত্রী-পুত্রের জন্য কোনো রকম চিন্তা না করেন। সেই জন্য সপরিবারে অবস্থান করিবার জন্য আরও একটি আবাসিক গৃহ নির্মাণ করা হইল। পরিবার পরিজন লইয়া তিনি তথায় অবস্থান করিয়াছিলেন।
দরবান শাহ (রহ.) ওই আস্তানায় সাচ্ছন্দ্যে বহুদিন অবস্থান করিয়াছিলেন। তৎকালে তাহাকে আবর্তন করিয়া ওই স্থানে একটি মক্তব গড়িয়া ওঠে। তিনি তথায়ও পাঠদান করিতেন।
শিষ্যগণ জীবন-জীবিকার চাইতেও অধিক গুরুত্ব দিতেন শাহের দরবারের খিদমতকে। তাই মহান সাধক বার্ধক্যে উপনীত হইবার পর গোসলে সাহায্যকারী মনোনীত ব্যক্তিগণ হাল-গরু ফেলিয়াও যথাসময়ে শাহের দরবারে উপস্থিত হইতেন।
মেয়াসাব সম্বোধন
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) শিক্ষাগ্রহণ শেষে মহান প্রভুর নৈকট্য সাধনে মনোনিবেশ করেন। তিনি ইসলামী গবেষণা করিতেন এবং মক্তবে পাঠদান করিতেন।
তাই শিক্ষার্থী ও স্থানীয় মুরিদানসহ ছেলে-বুড়ো সবাই তাঁহাকে সম্মানসূচক মেয়াসাব (মিয়া সাহেব) সম্বোধন করিতেন। দূর-দূরান্তের অনুসারীগণ তাঁহাকে হুজুর সম্বোধন করিতেন।
ধর্মীয় শিক্ষকগণকে তৎকালে মেয়াসাব বলিয়া সম্মানসূচক সম্বোধন করা হইত। তাঁহার পূর্বসুরি সাধকগণ তাঁহাকে সুফি সাব বলিয়া সম্বোধন করিতেন।
তবে যে যাহাই সম্বোধন করিতেন না কেন আধ্যাত্মিক গুরু হিসাবেই তাঁহাকে সবাই মনে-প্রাণে জ্ঞান করিতেন এবং মানিতেন।
আগাম অভিপ্রায় বুঝিবার শক্তি
মহান সাধক সুলতানুস সুফি হযরত নূরুজ্জামাল (রহ.) অনেক বিষয় আগাম বলিতে পারিতেন। ভক্তের বদনখানি দর্শন করিয়াই বুঝিতে পারিতেন- কি কহিতে চাহে। তাহাদের নালিশ-অভিপ্রায় বুঝিবামাত্রই আগাম উত্তর দিয়া দিতেন। ভক্তগণ সহসাই স্বীয় সংকটের আশু সমাধান পাইতেন।
দরবান শাহ্ (রহ.) মুরিদের হাড়ির খবরও রাখিতেন। তাই তাঁহার অন্তর্দৃষ্টির দরুন অনুসারীগণ নিজ কার্যকলাপ সম্পর্কে সর্বদাই সজাগ থাকিতেন।
সাধারণ মানুষের বিশ্বাস
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) যে একজন কামেল সাধক ছিলেন- এই বিষয়ে সর্বসাধারণ অগাধ বিশ্বাস করিতেন। অনুসারী হন নাই এমন মানুষও তাঁহার প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস ও গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করিতেন।
অনুসারীদিগের প্রতি এঙ্গোল মোল্লা (রহ.)-এর নির্দেশ
মহানসাধক দরবান শাহ্ (রহ.)-এর কঠোর সাধনা, ভাবাদর্শ, মূল্যবোধ এবং অনবদ্য গুরুভক্তি ও অটল বিশ্বাস তাঁহার প্রিয় মুর্শিদ সাধকপ্রবর এঙ্গোল মোল্লা (রহ.)-এর অন্তরে রত্নগাঁথা হইয়া গিয়াছিল। তিনি তাঁহার মর্মমূলে এতই বেশি পরিব্যাপ্তি লাভ করিয়াছিলেন যে, এঙ্গোল মোল্লা (রহ.) তাঁহার শিষ্যগণের প্রতি নির্দেশ করিলেন যেন তাঁহার মৃত্যুর পর উহারা দরবান শাহের নিকট বায়েত গ্রহণ করেন।
সাধকপ্রবর এঙ্গোল মোল্লা (রহ.)-এর মৃত্যুর পর মুরিদগণ দরবান শাহের নিকট বায়েত গ্রহণ করিয়াছিলেন পরম শ্রদ্ধায়।
শাহের মেজাজ
মহানুভব সাধক দরবান শাহ্ (রহ.) সঙ্গত ক্ষেত্রে মেজাজী ছিলেন। আবার সুবিচার-সুবিবেচনার দিক থেকেও তিনি ছিলেন অতুলনীয়। তাঁহার আনুগত্য গ্রহণ করিয়া অসংখ্য মানুষ ইহকালে শান্তি লাভ করিয়াছেন এবং পরকালের কল্যাণের জন্য সৎপথে সুখে-শান্তিতে ও পরম পরিতুষ্টিতে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করিয়াছেন। অপরদিকে তাঁহার অসন্তোষে কেহ কেহ গজবে নিপতিত হইয়া ইহলোক ত্যাগ করিয়াছেন। তদুপরি কখনোই তাঁহার মর্যাদা ম্লান হয় নাই। বরং বিভিন্ন ঘটনার দ্বারা মহান আল্লাহ্ তাঁহার অলীর মর্যাদা আরও বাড়াইয়া দিয়াছেন।
কথিত আছে, তাঁহার মেজাজকে উপেক্ষা করিয়া উক্তি করায় একজন শিক্ষিত মেধাবী মানুষ উদ্ভ্রান্ত হইয়া সমস্ত জীবন অতিবাহিত করিয়াছেন।
মুরিদের বাড়িতে দাওয়াত
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) মাঝে মধ্যে মুরিদের বাড়িতে দাওয়াত গ্রহণ করিতেন। একবার তাঁহার জনৈক মুরিদ ইচ্ছা করিলেন- মুর্শিদকে তাহার বাড়িতে দাওয়াত দিয়া লইয়া যাইবেন।
তিনি দরবান শাহ (রহ.)-এর জন্য তাহার বাড়িতে একটি কাছারিগৃহ নির্মাণ করিলেন। ইহার পর তাঁহাকে তথায় দাওয়াত করিলেন। অনেক আবেদন-নিবেদন করা সত্ত্বেও দরবান শাহ (রহ.) ওই মুরিদের বাড়িতে গমন করেন নাই।
আল্লাহর অলী মুরিদের বাড়িতে কেন দাওয়ান গ্রহণ করিলেন না- ইহার ব্যাখ্যা দেওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নহে। তথাপি সাধকগণ মনে করেন- আল্লাহর অলীগণ মহান প্রভুর মর্জি-খুশি ব্যতিরেকে এক পা’ও বাড়ান না।
দরবান শাহ্ (রহ.)-এর ঘনিষ্ঠ সহচরগণের মধ্যে কেহ কেহ সেইখানে তাঁহার গমন না করিবার ব্যাপারে সংশয় বোধ করিলেন। সহচরগণের ভ্রান্তি ভাঙ্গিবার জন্য দরবান শাহ্ (রহ.) যেই ইঙ্গিত করিলেন তাহার ভাবার্থ এই যে, ওই কাছারিগৃহে দরবান শাহের পদস্পর্শ ঘটিলে সেইটি উহাদিগের নিকট পবিত্র হইয়া উঠিবে এবং ওই গৃহকে তাহারা ভক্তি করিবে এবং কালের পরিক্রমায় একদিন তিনি নিজেই ওই গৃহে পীর সাজিয়া বসিবেন।
মহান আল্লাহ্তায়ালার অলীগণ মানুষের অন্তকরণ বা অভিপ্রায় বুঝিতে পারেন। দরবান শাহের ওই মুরিদান পরে কাছারিগৃহটিকে নামাজের গৃহ হিসাবে ব্যবহার করিতেন।
অনুসারীগণের প্রশ্নের উত্তর
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) অনুসারীদিগের বিভিন্ন প্রশ্নের গুরুগম্ভীর এবং দিকদর্শনমূলক উত্তর দিতেন। বিশ্লেষণধর্মী আলোচনার মাধ্যমে তিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সমাধান করিতেন। বাহুল্য আলাপ করিতেন না। তাই অনর্থক প্রশ্ন করাকেও অপছন্দ করিতেন।
অহেতুক অসংগত প্রশ্ন করা হইলে তিনি ঈষৎ রুষ্ট কিংবা বিব্রত হইতেন। ইহাতে কেহ কেহ তাঁহাকে মেজাজী মনে করিতেন। তাই অত্যাবশ্যকীয় বিষয় ব্যতিরেকে তাঁহার নিকট কেহ কোনোরূপ বাহুল্য প্রশ্ন লইয়া যাইতেন না।
তাঁহার মুখের প্রতিটি বাণী শ্রবণ করিবার জন্য সবাই অধীর আগ্রহে আকুল হইয়া থাকিতেন। গুরুত্বের সহিত আলোচনা শ্রবণ করিতেন এবং হৃদয়ঙ্গম করিবার চেষ্টা করিতেন।
গ্রন্থাগার
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) দেশ-বিদেশ ভ্রমণকালে বহু মূল্যবান কিতাবাদি সংগ্রহ করেন। ইসলামি বিষয়ের এইসব দুর্লভ গ্রন্থাদি দ্বারা একটি সংগ্রহশালা গড়িয়া ওঠে। যাহা এক সময় একটি গ্রন্থাগার হিসাবে রূপ লাভ করে।
এই পাঠাগারের পুস্তকাদি অধ্যয়ন করিয়া পরিবারবর্গের সদস্যগণ এবং অনুসারীগণ অগাধ জ্ঞান লাভ করেন।
ভাইয়ের সন্তানদের প্রতি ভালোবাসা
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর কনিষ্ঠ ভ্রাতা আবদুল আলী হাওলাদারও একজন সুফি সাধক ছিলেন। সাধনার এক পর্যায়ে তিনি ফকিরি জীবন যাপন শুরু করেন। মানুষের নিকট তাঁহার পরিচয় দিতেন ‘আবদুল ফকির’ নামে। যদিও সম্ভ্রান্ত হাওলাদার পরিবারে এই অতিকায় মানবের জন্ম। শেষ জীবনে তিনি মাজ্জুব হইয়া জগৎ সংসারের সমস্ত খেয়াল ছাড়িয়া দেন। তাহার ৩ পুত্র ও ২ কন্যাই হন এই বংশের উত্তরাধিকারী।
মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.) স্বীয় ভ্রাতার পুত্র-কন্যাদিগকে আপন সন্তানের মতোই ভালোবাসিতেন এবং সস্নেহে লালন করিতেন। তাহাদের লেখাপড়া, বিয়ে-শাদী সর্বোপরি সামাজিক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখিতেন। এই অপরিসীম আদরের কথা তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রী নূরবানু বেগম মাঝে মাঝে বলিতেন।
এই সাধকের আদুরে ভ্রাতুষ্পুত্রী অন্তঃপুরবাসী কিশোরী নূরবানু বেগম কাছারীগৃহের বা হুজরা শরীফের পিছনে দাঁড়াইয়া আধ্যাত্মিক বিষয়ের জ্ঞান-গম্ভীর আলোচনা শ্রবণ করিতেন তাহাও তিনি আড়াল হইতে টের পাইতেন। পরে তিনি সাক্ষাতে বলিতেন- ‘এই গরুচোখা মেয়েটা সব হা করে গিলে’।
একদিন তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রী বলিলেন- কালো গরুর গোশ্ত ভালো। এই কথা মহান অলীর কর্ণগোচর হইল। তিনি একটি কালো ষাঁড় সংগ্রহ করিয়া তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রীর জন্য জবেহ করিলেন। অতঃপর ভ্রাতুষ্পুত্রীর পছন্দসই রন্ধনকার্য করিতে তিনি পরিবারের লোকজনদিগের প্রতি নির্দেশ করিলেন।
যদিও মহান সাধকের স্ত্রী-পুত্রকে আল্লাহ্তায়ালা অগ্রেই দুনিয়া হইতে তুলিয়া লইয়াছেন। তদুপরি তাঁহার স্নেহের পাত্রটি তিনি উজাড় করিয়া গিয়াছেন প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র-পুত্রীদিগের জন্য।
সাধনার ধারা অর্পণের প্রস্তাব
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নুরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর সাধনা জীবন ছিল অত্যন্ত কঠিন। তিনি বার্ধক্যে উপনীত হইবার পর সাধনার পরবর্তী ধারা কাহার প্রতি অর্পণ করিবেন- এই বিষয়ে ভাবনায় পড়িলেন। তাহার নিজ পুত্রকে আল্লাহ্তায়ালা পূর্বেই দুনিয়া হইতে তুলিয়া লইয়াছেন। তাই তিনি তাহার ভ্রাতুষ্পুত্র আজহার উদ্দিন মাস্টারকে বলিয়াছিলেন, এই সাধনার ধারা তিনি অব্যাহত রাখিতে পারিবেন কিনা। এত কঠিন ব্রত পালনে তিনি সংশয় প্রকাশ করিলেন।
মহান সাধক তাঁহার হেদায়েতের ধারা অব্যাহত রাখিবার সঙ্গত প্রচেষ্টা তিনি করিয়াছিলেন। বাকিটুকু মহান আল্লাহর দরবারেই সঁপিয়াছিলেন।
মহান আউলিয়ার নিকট মানুষ কেন আসে
অনেক মানুষ বিপদগ্রস্ত না হইল অলী-আউলিয়ার দরবারে আগমন করেন না। মানুষ যখন বিপদ মুক্তির আর কোনো উপায় পান না। তখন আল্লাহর অলীর দরবারে আসেন। সমূহ বিপদটি অলীর কাছে আসার ওছিলা হলেও তিনি পেয়ে গেলেন মহামুক্তির একমাত্র অনুকূল পথ। অনেকেই আছেন যারা অলীর দরবারে সমূহ বিপদ মুক্তি ছাড়া আর কিছুই চান না। মহান আল্লাহর অলীগণ অনেক মর্যাদাবান। আউলিয়াগণের প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকলে তার ঈমান জাগ্রত ও মজবুত থাকে। মহান আল্লাহ তাহার কোনো বিপদ রাখেন না। মহান আল্লাহর অলীগণ আল্লাহ প্রদত্ত শক্তিতেই ক্ষমতাবান। তাই কামেল গুরুর সান্নিধ্যে থাকা প্রতিটি মানুষের জন্য জরুরি আবশ্যক। মহান আল্লাহ বিভিন্ন সময় মানুষকে বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। মহান আল্লাহর অলীগণ তাহাদের অস্তিত্বে আল্লাহকে অনুভব করিয়া থাকেন। তাহাদের মন আল্লাহময় অনুভূতিতে সদা আচ্ছন্ন থাকে। তাই তাহারা মানবকল্যাণের উত্তম পথের দিক-দিশা দিতে পারেন।
ভন্ডপীরের আবির্ভাব
একদা মাদারীপুর হইতে কারখানা গ্রামে এক ভন্ডপীরের আবির্ভাব ঘটে। তিনি সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন রকম অলৌকিক প্রলোভন দেখাইয়া মুরিদ বানাইতে লাগিলেন। সাধারণ মানুষও রাতারাতি ভাগ্যকে পরিবর্তন করিবার জন্য তাহার আনুগত্য স্বীকার কারিতে লাগিল।
দরবান শাহ্ (রহ.)-এর শিষ্যগণ ইহা জানিতে পারিলেন। তাহারা বিষয়টি শাহের গোচরে পেশ করিলেন। তিনি ওই পীরের আমল-আখলাক ও কার্যকলাপ সম্পর্কে জানিতে চাহিলেন। শিষ্যগণ বলিলেন- ওই পীর নামাজ-রোজা করে না। গোমরাহ্ মানুষদিগকে সঙ্গে টানিয়া মুরিদ বানাইতেছে। তাহার কার্যকলাপ কিছুই ভালো ঠেকিতেছে না।
দরবান শাহ্ (রহ.) ঘোর সন্দেহ পোষণ করিলেন। গ্রামবাসী ওই ভণ্ডপীরকে ‘চ্যালেঞ্জ’ (দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান) করিলে তিনি স্বপক্ষে অনড় থাকেন। এমনকি তাহাকে বাহাসের প্রস্তাব দেওয়া হইলে তিনি তাহাতেও সম্মত হইয়া যান।
কারখানা গ্রামে অবস্থিত রাহিমা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বাহাসের সিদ্ধান্ত হইল। বাজারে ঢাক পিটাইয়া কয়েক গ্রামের মানুষকে জানাইয়া দেওয়া হয়। বিশিষ্ট আলেম শামসুল হক মাওলানা ও বেলায়েত মৌলভীসহ আলেম-ওলামাগণকে দাওয়াত করা হয়। বিদ্যালয় মাঠে অনেক লোকের সমাগম হইল। আলেমগণ পবিত্র কোরআন-হাদীসের আলোকে ওই কথিত পীরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন। কিন্তু পীর নিশ্চুপ। কোনো উত্তরই তাহার ঝুড়িতে নাই।
আলেমগণ তাহাকে বিভিন্নভাবে যাচাই করিলেন। কিন্তু তাহার অজ্ঞতা, মূর্খতা আর ভন্ডামি ছাড়া আর কোনো জ্ঞান-গুণই প্রকাশ পাইল না।
অপরদিকে দরবান শাহ্ (রহ.)-কে ওই অভিন্ন প্রশ্নগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করিতে অনুরোধ করা হইলে তিনি ব্যাখ্যাসহ বিষয়গুলিকে বুঝাইয়া দিলেন। ইহাতে উপস্থিত বিজ্ঞ মহল সন্তুষ্ট হইলেন।
আর সকলেই রুষ্ট হইলেন ওই দূরাগত কথিত পীরের উপর। গ্রামবাসী মুরীদসহ ভন্ডপীরকে গণধোলাই দিয়ে বিতাড়িত করিলেন।
এই ঘটনায় দরবান শাহ্ (রহ.)-এর প্রতি গ্রামবাসী এবং আগত মানুষের ভক্তি-বিশ্বাস আরও প্রগাঢ় ও সুদৃঢ় হইল। তাঁহারা বুঝিতে পারিলেন মহান আল্লাহ্ তাহাদের মাঝে একজন খাঁটি অলীকে প্রেরণ করিয়াছেন। তাই তাহারা দরবান শাহ্কে পূনরায় পরম শ্রদ্ধাভরিয়া গ্রহণ করিলেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মহান সাধক দরবান শাহ (রহ.) ইসলামী গবেষক ও সুপণ্ডিত ছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি সেই দিন ওই মজলিসে তাঁহার পাণ্ডিত্যের পরীক্ষা দিতে যান নাই- বরং তিনি চাহিয়াছিলেন গ্রামের মানুষের উপর হইতে ভণ্ডপীরের অশুভ ছায়া অপসারিত হউক।
দক্ষিণাঞ্চল হইতে বিদায়
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহঃ)-এর মৃত্যুর আভাস মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁহাকে পূর্বেই দিয়াছিলেন। তিনি তখন দক্ষিণাঞ্চল তথা উপকূলীয় অঞ্চল সফর করিতেছিলেন। অনুসারীদিগের উদ্দেশ্যে বলিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর আমাকে নিজের বাড়ির আমার পূর্বপুরুষের গোরস্থানে দাফন করিও’।
মহান আল্লাহ্ তাহাকে জানাইলেন মৃত্যুর পর মুরিদানগণ তাহাকে ওই আস্তানায় দাফন করিতে চাহিবে। এই সম্পদ উহারা ছাড়িতে চাহিবে না। অবশেষে তিনি সফরের সমাপ্তি টানিয়া পৈত্রিক বাড়িতে ফিরিবার ঘোষণা দিলেন।
তিনি জীবন-যাপন করিতেন অতি সাধারণ। আর আধ্যাত্ম মহিমায় ছিলেন এক মহামতি রাজা। মুরিদ মারফত তিনি নিজ বাড়িতে বার্তা পাঠাইলেন তাঁহাকে লইয়া আসিবার জন্য।
তাঁহার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচর কারখানা গ্রামের আজহার মুন্সি তাঁহাকে আনিতে যাইবার জন্য মনোনীত হইলেন। তিনি দক্ষিণাঞ্চলীয় আস্তানায় দরবান শাহ্ (রহ.)-এর নিকট উপস্থিত হইলেন।
দরবান শাহের বাড়ি ফেরার জন্য নৌকা প্রস্তুত করা হইল। নদীর পাড়ে ভক্তগণ সমবেত হইতে লাগিলেন। তিনি যাত্রা করিয়া নদীর পাড়ে আসিয়া ক্ষাণিক দাঁড়াইলেন।
অতঃপর তিনি শিষ্যগণের উদ্দেশ্যে বিদায় বাণী প্রদান করিলেন। ভক্তগণকে কাঁদাইয়া প্রাণপ্রিয় মানব অপেক্ষমান নৌকায় আরোহণ করিলেন।
মহান আল্লাহর অলীকে লইয়া তীর হইতে তরীখানি ছাড়িয়া দিল। — নদীর বুকে শাহের নাও চলিতে লাগিল। ভক্তগণ তীরে দাঁড়াইয়া সজল নয়নে অবলোকন কারিতে লাগিলেন- যতক্ষণ নৌকাখানি দৃষ্টিসীমার মধ্যে রহিল।
নতুন দায়রা শরীফ নির্মাণ
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.) বাড়িতে আসিবার পর কাছারিঘর থাকা সত্ত্বেও একটি নতুন দায়রা শরীফ নির্মাণ করা হয়। অনেকের ধারণা হইল- মৃত্যুর পর ওনাকে ওইখানেই সমাহিত করা হইবে। কিন্তু বিষয়টি তাহা ঘটেনাই। এরপর তিনি প্রায় ৬ মাস সুস্থভাবে বাঁচিয়াছিলেন।
কবরের স্থান নির্বাচন
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর পরিববারবর্গ ও অনুসারীগণ মনে করিতেন মৃত্যুর পর তাঁহাকে বাড়ির ভিতর হুজরা শরীফেই সমাহিত করা হইবে। প্রসঙ্গতঃ কারণ হইল- আল্লাহর অলীগণ যেইখানেই দেহত্যাগ করেন সাধারণতঃ সেইখানেই তাঁহাকে সমাহিত করা হইয়া থাকে। যদি কোন বিশেষ পরিস্থিতি উদ্ভুত না হয়।
আল্লাহর অলী তাঁহার পরিববারবর্গের ও অনুসারীগণের ভাবনার বিষয়টি আঁচ করিতে পারিলেন। তিনি তাহাতে অসম্মতি জানাইলেন। অতঃপর বিষয়টি লইয়া তিনি আলোচনা করিলেন এবং বলিলেন, তাঁহাকে যেন পূর্বপুরুষের গোরস্থানেই দাফন করা হয়।
মহামতি সাধকের ইচ্ছা অনুযায়ী পূর্বপুরুষের গোরস্থানেই তাঁহাকে সমাহিত করা হয়।
পক্ষান্তরে দেখা যাইতেছে, তাঁহার বাড়ির হুজরা শরীফটি এখন ‘কারখানা নদী’র মধ্যবর্তী স্থানে গভীর জলরাশিতে বিলীন। আর বিদ্যমান কবরস্থানের প্রান্তঘেঁসিয়া প্রমত্তা কারখানা নদী এখন স্থিমিত এবং ধীর বহমান।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, একদিন দরবান শাহ্ (রহ.) তাঁহার অনুসারী সাধকগণকে লইয়া বাড়ির সম্মুখভাগে পায়চারি করিতেছিলেন। তখন উহাদিগের মধ্যে একজন সাধক পায়ের নিচের মাটিকে লক্ষ্য করিয়া বালিয়া উঠিলেন- ‘এ তো নদী! এ তো নদী!’ এই কথা শুনিয়া শাহের ভ্রাতুষ্পুত্রী কিশোরী শহরবানু বেগম তাঁহার মাতার নিকট গিয়া বলিলেন। তাঁহার মাতা অন্তঃপুরবাসী জয়নব বিবি বলিলেন, ‘হায় হায়! সে কি, তুমি দরজায় গিয়াছিলা? খবরদার আর কখনও ওই দিকে যাইও না।’ কঠোর পর্দাপ্রথা ও পারিবারিক রক্ষণশীলতার কারণে তিনি তাঁহার কন্যাকে ওই কথা বলিয়াছিলেন।
সাধকগণ বাড়ির ভিতর যেই স্থানটিকে ‘নদী’ বলিয়াছিলেন সে স্থানটি বর্তমানে নদীর সর্বাপেক্ষা গভীর অবস্থানে রহিয়াছে।
উল্লেখ্য যে, ভাঙ্গনসংকুল প্রমত্তা কারখানা নদী (পায়রা নদী) তৎকালে দরবান শাহের বাড়ির প্রায় এক মাইল পশ্চিম দিয়া প্রবাহিত হইতেছিল।
কাফনের কাপড়
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর মৃত্যুর দিনক্ষণ সমাগত হইতে লাগিল। তিনি নিজের অন্তিম বিদায়ের জন্য সকল প্রকার আয়োজন করিতে শুরু করিলেন। কাফনের কাপড় ক্রয় করিয়া তাহা স্বহস্তে কর্তন করিলেন। কাপড়গুলো ভাঁজ করিয়া একটি ট্রাঙ্কে সাজাইয়া রাখিলেন। অজু-গোসলের জিনিসপত্র ও সুগন্ধিসহ মুর্দারের যাবতীয় সামগ্রী ওই ট্রাঙ্কে সাজাইয়া রাখা হইল।
মাজারের উত্তর-পশ্চিম দিকের পারিবারিক বাগানে অনেকগুলো বাঁশঝাড় ছিল। তথা হইতে পছন্দের বাঁশগুলো তাঁহাকে দাফনের জন্য বাছাই করে কর্তন করা হয়।
তাঁহার মৃত্যুর পর কাফনসামগ্রীর ওই ট্রাঙ্কটি খোলা হয়। কাপড়সহ সকল সামগ্রী দ্বারা অন্তিম যাত্রার মিছিলের জন্য তাঁহাকে সাজানো হয়। নিজের সমস্ত আয়োজন দ্বারাই ভাবগম্ভীর আবেশে তাহাকে মাটির কোলে সমাহিত করা হয়।
ভক্তকুলকে কাঁদাইয়া তিনি ‘কারখানা’ গ্রামের পবিত্র মাটিতে চির শায়িত হইলেন। আর অনুসারীগণের মাঝে রাখিয়া গেলেন খোদাপ্রেমের চিরন্তন শিক্ষার সুমহান আদর্শ।
জীবনের অন্তিম লগ্ন
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর চিরবিদায়ের দিন-ক্ষণ ঘনাইয়া আসিল। তিনি সবাইকে তাঁহার অন্তিম উপদেশ বাণী প্রদান করিতে লাগিলেন।
মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সুস্থ-স্বাভাবিক ছিলেন এবং কথা-বার্তা বলিয়াছিলেন। বাদ ফজর দিবসের প্রারম্ভে মৃত্যুদূত যখন তাহাকে আবিষ্ট করিল তখন তিনি শয্যা গ্রহণ করিলেন।
ধীরে ধীরে তাহার শরীর, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ হইয়া আসিতে লাগিল। তিনি মহান আল্লাহর জ্বিকির করিতেছিলেন।
সমস্ত শরীর যখন অসার হইয়া গেল তখনও তাঁহার বক্ষ অভ্যন্তরে আল্লাহর জ্বিকির ধ্বনিত হইতেছিল।
বিশিষ্ট খাদেম আজহার মুন্সিসহ শাহের ঘনিষ্ঠ সহচরগণ বলিয়াছেন- শিশু যেমন মাতৃদুগ্ধ পান করিতে করিতে মায়ের কোলে ঘুমাইয়া পড়ে, তেমনি তিনি আল্লাহর জ্বিকির করিতে করিতে অন্তিম শয্যায় ইহলোক ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
সেই দিন ছিল দোসরা শ্রাবণ ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ। তখন তাঁহার বয়স হইয়াছিল ১০৫ বৎসর। তাঁহার জন্মসন ছিল ১২৬০ বঙ্গাব্দ।
আস্সালামু আলাইকা ইয়া মুর্শিদেনা। আস্সালামু আলাইকা ইয়া অলীউল্লাহ।
মাজার জিয়ারতের আদব
মহান অলী-আউলিয়ার মাজার জিয়ারতের মধ্যে অনেক তাৎপর্য নিহিত রহিয়াছে। মহান আল্লাহর অলীর মাজার জিয়ারত করিতে আসিয়া অনেক লোক ভক্তির আতিশয্যে অহেতুক ফেতনার সৃষ্টি করিয়া থাকেন। তাই ইসলামি ভাবাদর্শ বহির্ভূত কোনো কাজ করা কিছুতেই বাঞ্ছনীয় নহে।
মানুষ বিভিন্ন রকম শুভ কাজে কিংবা বিপদ-আপদে মহান আল্লাহ্তায়ালার রহমত কামনা করেন। তাই মহামানবের উছিলা ধরিয়া তাহারা পরম করুণাময়ের কাছে কল্যাণ প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ্তায়ালা তাহার প্রিয় আউলিয়ার প্রতি ভালোবাসা ও মর্যাদার খাতিরে পাপিতাপী মানুষের প্রার্থনা কবুল করেন। তাই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিধান মতোই তাহার অলীর মাজার জিয়ারত করা আবশ্যক। তবে মহান আল্লাহর সঙ্গে কোনোরূপ শরীক হয় এমন কোনো কাজ করা হইতে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি।
মুর্শিদের সহচর
মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.)-এর প্রিয় মুর্শিদ সাধকপ্রবর এঙ্গোল মোল্লা (রহ.)-এর পবিত্র মাজার করালগ্রাসী কারখানা নদীর গহনে অবলুপ্ত হইয়াছে। মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁহার অলীর মাজার বা তাহার মর্যাদা কিভাবে হেফাজত করিবেন উহা তিনিই সম্যক সুজ্ঞাত। সাধারণ মানুষের পক্ষে উহা বুঝিবার সাধ্য নাই।
মহান আল্লাহর অলীগণ নিঃসংশয়, নিরুদ্বিগ্ন, অটল প্রত্যয়ী এবং সর্বজয়ী। আকাশ-পাতাল, আগুন-পানি- কোনো কিছুই প্রভুপ্রেমে তাহাদের বিঘ্ন ঘটায় না। বিশ্ব চরাচরে তাঁহারা আলোকময় অভিযাত্রী।
একজন সাধক বর্ণনা করেন, তিনি স্বপ্নযোগে দর্শন করেন- এঙ্গোল মোল্লা (রহ.) নদীতে কি যেন করিতেছেন। তাঁহার সঙ্গে একজন সহচর রহিয়াছেন। ওই সাধক বর্ণনা করেন, এঙ্গোল মোল্লা (রহ.)-এর সঙ্গে যাহাকে দেখিয়াছি তিনিই দরবান শাহ্ (রহ.)।
প্রসঙ্গ : কারামত
মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁহার অলীকে মানুষের মধ্যে প্রকাশ করিবার জন্য কারামত প্রদর্শন করিয়া থাকেন। যেন মানুষ আল্লাহর অলীকে অনুসরণ করিয়া বিপদ-আপদ, পাপ-পঙ্কিলতা হইতে মুক্ত থাকিতে পারে। মানুষ যেন তাহার কৃত পাপকর্মের জন্য আল্লাহর অলীর উসিলা ধরিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং সৎপথ অবলম্বন করিতে পারে।
মহান সাধক হযরত নূরুজ্জামাল (রহ.) সহচরদিগকে বলিতেন, তোমরা কেহ কারামত লইয়া প্রভাবিত হইও না। অহেতুক কারামত দেখাইলে সাধনালব্ধ পূণ্যের পাত্র শূন্য হইয়া যায়। যখন কারামতের প্রয়োজন হয় তখন মহান আল্লাহ্ উহা নিজেই ঘটাইয়া থাকেন। তোমাদের নিজের ইচ্ছা কি সেইটা মোদ্দা কথা নহে। আল্লাহ্ কি চাহেন সেইটাই মুমিনদিগের করণীয়। আমরা তো তাঁহারই ইবাদত-আরাধনা করি।
এই মহান সাধকের জীবনকালে অনেক অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল। তাঁহার মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী পরও অসংখ্য কারামত সংঘটিত হইতেছে।
দরবান শাহ্ (রহ.)-এর সহচরগণ এমন সব অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করিয়াছেন- যাহা সকলের নিকট প্রকাশ করিতে ঘোর আপত্তি প্রকাশ করেন। কারণ উহা মানুষের নিকট বিশ্বাস হইবে না কিম্বা তাহাদের মনে সংশয় সৃষ্টি করিবে। ইহা লইয়া উহারা তর্কে লিপ্ত হইবে। তাই সর্বজনবিদিত কয়েকটি ঘটনা এখানে সন্নিবেশিত করা হইল।
স্বর্গীয় আলোর উদ্ভাস
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর ইন্তেকালের কিছুকাল পর এক অমাবশ্যা রাত্রিতে ফজলুর রহমান গাজী সদর দরোজার পুকুরের পশ্চিম পাড়ে দাঁড়াইয়া এক অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করিলেন।
তিনি দরবান শাহের ভ্রাতুষপৌত্র কিশোর শাহজাহান হাওলাদারকে ডাকিয়া বলিলেন, পূর্বদিকে তাকাও। তিনি তাকাইয়া দেখিলেন দরবান শাহ (রহ.)-এর মাজারময় এক স্বর্গীয় আলোয় উদ্ভাসিত হইয়া রহিয়াছে। গাঢ় অন্ধকার রাত্রিতে অদৃশ্য উৎসের এই আলো ঝলমল দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিয়া উপস্থিত আরও অনেকেই আপ্লুত হইলেন।
এমনই বহু ঘটনা দ্বারা মহান আল্লাহ্ তাঁহার অলীর মাহাত্ম্যকে মানুষের মাঝে প্রকাশ করিতেছেন।
জাল দলিল মামলায় ৬ জন খালাস
জাল দলিলের এক মামলায় কারখানা গ্রামের আহম্মদ কাজীসহ ৬ জন অভিযুক্ত আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হইলেন। আসামী পক্ষের উকিল বলিলেন- আপনাদেরকে আর রক্ষা করা গেল না।
চূড়ান্ত রায়ের তারিখ ঘোষিত হইল। এখন অবধারিত জেল। আহম্মদ কাজী মহাবিপাকে পড়িলেন। উপায়ান্তর খুঁজিয়া পাইতেছিলেন না।
অবশেষে দরবান শাহ (রহ.)-এর কথা তাহার স্মরণে আসিল। তিনি দরবান শাহের শরণাপন্ন হইবার জন্য মন স্থির করিলেন। অতঃপর তিনি দরবান শাহের ঘনিষ্ঠ সহচর জয়নাল মৃধাকে বিষয়টি বলিলেন। জয়নাল মৃধা বলিলেন, এই বিষয় লাইয়া ওনার নিকট যাওয়া যাইবে না।
আহম্মদ কাজী অনন্যোপায় হইয়া বলিলেন- আপনি আমার দোস্ত, আপনার দোহাই লাগে- আমাদিগকে রক্ষা করুন।
জয়নাল মৃধা নালিশটি দরবান শাহ্কে জানাইলেন। দরবান শাহ্ বলিলেন- তাহারা অপরাধ করিয়াছে, শাস্তি তো তাহাদের হইবেই। আমি ইহার কি করিব?
জয়নাল মৃধা আহম্মদ কাজীকে বলিলেন- ইহা সম্ভব নহে। বিষয়টি আমি ‘মেয়াসাব’কে জানাইয়াছি। উনি ইহাতে রাজি হইতেছেন না।
কাজী কিছুতেই তাহাকে ছাড়িতে চাহিতেছেন না। তিনি বলিলেন- মেয়াসাবের কথা আমরা মানিয়া লইব, তাঁহার যে কোনো নির্দেশ আমরা পালন করিবো, শুধু আমাদের রক্ষা করুন।
জয়নাল মৃধা পুনরায় দরবান শাহের নিকট গেলেন।
মহান আল্লাহর অলী ঈষৎ সম্মত হইলেন। তিনি খোশ মেজাজে বলিলেন- উহাদিগকে তো কিছু কাফফারা দিতে হইবে।
আহম্মদ কাজীকে বলা হইলে তিনি বলিলেন, মেয়াসাব যাহা বলিবেন আমরা তাহাই দিব।
দরবান শাহ্কে কাজীর অঙ্গীকার জানাইলে তিনি বলিলেন- উহাদিগকে মাহফিলের সময় একটি গরু ও এক মণ চাউল দিতে বলিও।
এই কথায় সম্মত হইয়া আহম্মদ কাজী খুশি মনে বাড়িতে চলিয়া গেলেন।
কয়েক দিন পর দরবান শাহ্ (রহ.) বলিলেন- ওদের মামলার তারিখ কবে তাহা তো কিছুই জানাইলা না।
জয়নাল মৃধা বলিলেন- মেয়াসাব! ওদের মামলার তারিখ আগামীকাল।
মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.) পরের দিন ফজরের নামাজ আদায় করিয়া প্রত্যুষে সকলকে বলিলেন- ‘আমি যতক্ষণ না ডাকি তোমরা ততক্ষণ কেহই আমার নিকট কোনো বিষয় লইয়া আসিও না। এমনকি খাবারও না।’ অতঃপর তিনি হুজরা শরীফে মোরাকাবায় বসিলেন।
অনুসারীগণ বুঝিতে পারিলেন, মহান আল্লাহর দরবারে তিনি ওই ছয় আসামীর পরিত্রাণ প্রার্থনা করিবেন।
ভক্তগণ আল্লাহর অলীর দরবারের চারিদিকে দায়িত্ব পালন করিতেছেন। মুখ চাওয়া-চাওয়ী ছাড়া কেহ কাহাকেও কিছু বলিতেছেন না। কি হইবে মামলার ফয়সালা? এই প্রশ্ন সকলের মনে তাড়িত হইতে লাগিল। মহান আল্লাহ্ তাঁহার অলীর মর্যাদা রক্ষা করিবেন কিনা? নাকি আল্লাহর অলীর প্রতি মানুষের বিশ্বাস সংশয়বিদ্ধ হইবে? এমন ভাবনায় অনুসারীগণ সময় অতিবাহিত করিতে লাগিলেন।
দরবান শাহের সকালের নাস্তা প্রস্তুত হইল। কিন্তু তাঁহার ধেয়ান ভাঙ্গিতেছে না। সবাই প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
সকাল অতিক্রান্ত হইয়া গেল। তাঁহার দুপুরের খাবারও প্রস্তুত হইল। কিন্তু মোরাকাবা ভঙ্গ হইতেছে না।
যোহর সমাগত। তিনি ডাইনে-বামে তাকাইলেন। সকলে আগাইয়া আসিলেন।
দরবান শাহ্ বলিলেন- ‘কী তোমরা আমাকে ভাত-পানি খাওয়াইবা না?’ ভক্তগণ বলিলেন- জ্বী মেয়াসাব! আপনার খাবার প্রস্তুত। আপনার জন্য আমরা অপেক্ষায় রহিয়াছি।
অতঃপর তাঁহার সম্মুখে খাবার পারিপাটি সাজানো হইল। তিনি খাবার গ্রহণ করিলেন। ক্ষাণিক পর ভক্তগণ তাহার বদনপানে লক্ষ করিলেন- তিনি খোশ মেজাকে রহিয়াছেন।
জনৈক খাদেম বলিলেন- মেয়াসাব! ওদের ছয়জনের কি হইল কোনো খবর পাইলাম না।
মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.) দরাজ কণ্ঠে বলিলেন- ‘ওদের ছয়জনেরই খালাস হইয়া গিয়াছে’।
মহান সাধক মোরাকাবায় সঙ্গে সঙ্গেই জানিতে পারিলেন- মহান আল্লাহ্ তাহাদিগে ক্ষমা করিয়াছেন এবং আদালত উহাদিগে খালাস দিয়াছেন।
উল্লেখ্য যে, কারখানা গ্রাম হইতে পটুয়াখালী শহরের বিচারিক আদালতের দূরত্ব আনুমানিক ৩০ কিলোমিটার। খাল-বিল ও নদী-নালা বেষ্টিত দুর্গম উপকূলীয় অঞ্চল- যেখানে নৌকাই একমাত্র ভরসা। ততকালে টেলিযোগাযোগ কিংবা কোনোরূপ যান্ত্রিক বাহনে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল না। সাজা মওকুফ ছয়জন যখন গয়নার নাওযোগে বাড়ির দেড় কিরোমিটার দূরত্বে ঝিলনা ঘাটে আসিয়া নামিলেন তখন বেলা গিয়া সন্ধ্যা উপস্থিত।
খালাসপ্রাপ্তগণ দরবান শাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া জানাইলেন- তাহারা নথিসহ খালাস পাইয়াছেন।
এই ঘটনার পর অনেক দিন অতিবাহিত হইয়া গেল। মাহফিলের দিন ঘনাইয়া আসিতে লাগিল। এইবার মানত আদায় করিবার পালা।
আহম্মদ কাজী জানাইলেন- দুইটি গরুর একটি দিলে তিনি কি দিয়া হালচাষ করিবেন।
মাহফিলের দিন আসিল। ভক্তগণ ভাবনায় পড়িলেন। দরবান শাহ্ (রহ.) বলিলেন তোমরা চিন্তা করিও না। অন্য সমস্ত আয়োজন কর। সকল ব্যবস্থা হইবে।
ওই দিকে আহম্মদ কাজীর একটি গরু ঘাসের ময়দানে দড়ি পেঁচাইয়া মারা গেল। অপরটিও হঠাৎ অসুস্থ হইয়া পড়িল। কাজী হতাশ হইয়া মাহফিলে আসিয়া পরিত্রাণ প্রার্থনা করিলেন।
দরবান শাহ্ (রহ.) শিষ্যদিগকে বলিলেন- ওই অসুস্থ গরুটিই মাহফিলে নিয়া আসিতে বল।
আহম্মদ কাজী যখন তাহার গরুটি আনিতে লাগিলেন তখন গরুটি সুস্থ হইয়া স্বাভাবিকভাবে হাঁটিয়া আসিতে লাগিল। যেন মাহফিলে আসিবার জন্যই গরুটি ছটফট করিয়াছিল।
আহম্মদ কাজী এক মণ চাউল ও একটি গরু দ্বারা তাহার মানত আদায় করিয়া চির কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন।
কাফন পড়ানো লাশ
দরবান শাহ্ (রহ.)-এর ঘনিষ্ঠ সহচর জয়নাল মৃধা একদিন সোবেহ সাদেকের সময় ফজরের নামাজের উদ্দেশ্যে দরবান শাহের দায়রা শরীফে প্রবেশ করিলেন।
তিনি দেখিতে পাইলেন- কাফনের কাপড় পড়ানো অবস্থায় দরবান শাহ্ (রহ.) মুর্দা অবস্থায় রহিয়াছেন।
জয়নাল মৃধা বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। মুর্দারের পদ ও মস্তকের নিকট কাপড়ের প্রান্তদেশ টানটান করিয়া মোড়ানো।
তিনি মনে মনে বলিলেন- মুর্শিদ আমাকে না বলিয়া চলিয়া গেলেন? না! ইহা হইতে পারে না। তিনি আমাকে না বলিয়া এইভাবে চলিয়া যাইতে পারেন না। ইহা আমি বিশ্বাস করি না। তাহা হইলে এতদিন আমি কি সাধনা করিলাম? মুর্দারের দিকে তাকাইয়া তিনি অনেক আক্ষেপ করিলেন। অতঃপর তিনি মনকে বুঝাইলেন- ঠিক আছে, তিনি যদি চলিয়া গিয়াই থাকেন তবে আগে নামাজ পড়ি। তারপর দেখি, কি এই রহস্যময়তা।
তিনি হুজরা শরীফের দরজার খিলটি বাহির হইতে বন্ধ করিয়া অজু করিতে গেলেন। অজুশেষে দরজার খিলটি খুলিয়া হুজরা শরীফে পুনরায় প্রবেশ করিলেন।
তিনি দেখিতে পাইলেন- দরবান শাহ্ (রহ.) নামাজ আদায় করিতেছেন তাঁহার চিরাচরিত পোশাকে। কোথাও মুর্দা নাই। কাফনের কাপড়ও নাই।
দুই স্থানে ইফতারে শামিল
মহান সাধক হাদী হাজী শাহ্ সুফি হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান আলী (রহ.)-এর দরবারের এক মজলিসে শাহের অনুপস্থিতকালে মুর্শিদ সম্পর্কে অনুসারীগণ আলোচনা করিতেছেন। একজন বলিলেন মেয়াসাব অমুক দিন আমাদের বাড়িতে ইফতার করিয়াছেন। অপরজন বলিলেন- না। উনি তো সেই দিন আমাদের বাড়িতে ইফতার করিয়াছেন। এই বলিয়া দুই পক্ষের মধ্যে বাদানুবাদ হইতে লাগিল। তাহারা পরস্পরকে মিথ্যাবাদী মনে করিতে লাগিলেন। মজলিসের পরিবেশ কিছুটা উত্তপ্ত হইল।
এমন অবস্থা দেখিয়া একজন সাধক বলিলেন, আপনারা থামুন। আল্লাহর অলীগণ একই সময়ে একাধিক স্থানে উপস্থিত থাকিতে পারেন। এই কথায় সকলের বোধোদয় হইল। তাহারা ক্ষান্ত হইলেন এবং আল্লাহর অলীর মাহাত্ম্যকে উপলব্ধি করিবার চেষ্টা করিলেন।
দরবান শাহের ছড়ি
দরবান শাহ (রহ.)-এর ভ্রাতুষপৌত্র শাহজাহান হাওলাদার একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। পটুয়াখালী শহরে নিজের প্রতিষ্ঠিত বাড়িতেই সপরিবারে বসবাস করেন।
একদিন তাহার একমাত্র কন্যা সেলিনার অ্যাপেন্টিসাইটিসের প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হইতে লাগিল। ব্যথার তীব্রতায় তাহার শরীর নিস্তেজ হইয়া আসিল। আশংঙ্কাজনক অবস্থায় তাহাকে হাসপাতালে নিবার জন্য একটি রিকশায় তোলা হইল। তখন মধ্যরাত্রি।
মফস্বল শহরে রাত্রির নির্জন পথে আলো-আঁধার ভেদ করিয়া রিকশা চলিতেছে হাসপাতাল অভিমুখে।
শাহজাহান হাওলাদার সম্মুখে দেখিতে পাইলেন একজন দরবেশ রাস্তার মধ্যখানে পথ আগলাইয়া বসিয়া রহিয়াছেন। তাঁহার হাতের লাঠিখানাও আড়াআড়িভাবে রাস্তার উপর রাখিয়াছেন, যাহাতে রিকশাটি অকুস্থল অতিক্রম করিতে বাধাপ্রাপ্ত হয়।
রিকশাটি কাছাকাছি আসিতেই থামিবার জন্য দরবেশ ইশারা করিলেন। রিকশাটি থামিয়া গেল। তিনি শাহজাহান হাওলাদরকে নামিয়া আসিতে ইশারা করিলেন।
তিনি রিকশা হইতে নামিয়া দরবেশের নিকট আসিলেন। দরবেশ বিজ্ঞাসা করিলেন- ‘রিকশায় কে?’ তিনি বলিলেন আমার মেয়ে। দরবেশ বলিলেন ‘মেয়ে নয়- মা’!
অতঃপর দরবেশ জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘মায়ের কি হইয়াছে?’ তিনি বলিলেন- অ্যাপেন্টিসাইটিসের প্রচণ্ড ব্যথা। উহাকে হাসপাতালে লইয়া যাইতেছি।
দরবেশ বলিলেন- ‘কিছু হয় নাই। একটু পানি লইয়া আস।’ অতঃপর নিকটস্থ একটি বাড়ি হইতে পানি সংগ্রহ করা হইল। দরবেশ বলিলেন- ‘একটু পানি মায়ের উপর ছিটাইয়া দাও।’
এইবার দরবেশ মেয়েটিকে বলিলেন- ‘মা নামিয়া আস’। মেয়েটি ধীর পদক্ষেপে নামিয়া আসিল। দরবেশ জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘এখন কেমন লাগিতেছে’। মেয়েটি বলিল- ভালো।
দরবেশ বলিলেন- ‘এইবার বাড়িতে চলিয়া যাও’।
কন্যাকে লইয়া শাহজাহান হাওলাদার স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিলেন। তিনি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করিলেন- এখন কেমন অবস্থা? মেয়ে জানাইল এখন সম্পূর্ণ ভালো। আমার কিছু হইয়াছিল, এখন আর এমনটি মনে হইতেছে না।
কন্যার তীব্র ব্যথায় শাহজাহান হাওলাদার দম্পতি অস্থির হইয়া গিয়াছিলেন। ঘর-সংসারের সবকিছু তুচ্ছ মনে হইয়াছিল। অন্য সন্তানদিগেরও কোনো খবর লইতে পারেন নাই।
কন্যাকে সুস্থ করিয়া বাসায় লইয়া আসিবার পর তাহারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিতেছিলেন। এমন সময় কনিষ্ঠ পুত্রের ক্রমাগত আর্তনাদ শুনিতে পাইলেন তাহার গৃহমাতা।
পুত্রের কক্ষে গৃহকর্ত্রী গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- কি হইয়াছে? পুত্র জানাইল- সমস্ত দিবস ধরিয়া প্রচণ্ড মাথাব্যথা হইতেছে।
তাহার মায়ের মনে পড়িল দরবেশ রাস্তার কিনারা হইতে একটি শিকড় তুলিয়া দিয়াছিলেন। তিনি এক গ্লাস পানিতে ওই শিকড়টি চুবাইয়া পুত্রের জন্য তাহার কক্ষে লইয়া গেলেন।
পুত্র পানি পান করিয়া জিজ্ঞাসা করিল- ইহা কিসের পানি? তাহার মা বলিলেন- কেন বাসার জগের পানি!
পুত্র বলিল- না, ইহা কোনো সাধারণ পানি নহে। প্রশান্তিতে আমার সমস্ত শরীর শীতল হইয়া গিয়াছে। এখন কোনো মাথাব্যথাও নাই। তাহার মা তখন ছেলেকে বিষয়টি খুলিয়া বলিলেন।
পুত্রকন্যার সুস্থতায় শাহজাহান হাওরাদার স্বস্তি পাইলেন বটে। কিন্তু তাহাকে একটি বিষয় ভীষণ আলোড়িত করিল। তিনি আকুল হইয়া বর্ণনা করিলেন- দরবান শাহের সেই ছড়িখানা আমি ওই দরবেশের হাতে দেখিয়াছি।
এই ঘটনা আমাদেরকে গভীর ভাবনার জগতে নিয়ে যায়।
ব্যথার বরফশীতল উপশম
এই লেখকের একটি ঘটনা। মহান সাধক দরবান শাহ্ (রহ.)-কে তিনি দিব্যদৃষ্টিতে দর্শন করেন নাই। কারণ এই মহামানবের ওফাতের ৯ বৎসর পর লেখকের জন্ম। তাহার মাতামহী ছিলেন দরবান শাহের ভাদ্রবধূ জয়নব বিবি। যিনি দরবান শাহের জীবন যাপনের সবকিছু দেখাশোনা করিতেন। এমনকি দরবান শাহের অন্তর্ধানের পরও সমস্ত জীবন তাঁহার দরবারের মাসিক মাহফিলসহ সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকি করিতেন। সর্বময় কর্তৃত্ব তাহার উপরই ন্যাস্ত হইয়াছিল।
তাঁহার ঈমান, আমল-আখলাক, শিক্ষা-দীক্ষা সর্বোপরি বিশুদ্ধ ইবাদত তাহাকে দরবান শাহের উসিলার যোগ্য ধারক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। সাধনার দ্বারা তিনিও হইয়াছিলেন একজন কামেল মহিয়সী নারী।
এই লেখকের বয়স তখন পাঁচের কোঠায়। মাতুলালয়ের উদ্যানে ক্রীড়া করিতে গিয়া তাহাকে একটি বিষডাইয়া হুঁল ফুঁটাইয়াছিল। তিনি তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করিয়া ক্রন্দন করিতেছিলেন।
দৌহিত্রের ক্রন্দন শুনিয়া জয়নব বিবি তড়াইয়া আসিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন- কি হইয়াছে। তাঁহার নাতি হাফপ্যান্টের রাবার বরাবর ফুলিয়া যাওয়া অংশ দেখাইলেন।
জয়নব বিবি ক্ষাণিক নীরবে মুখ নাড়িয়া দোয়া পড়িলেন এবং নাতির আক্রান্ত স্থানে আস্তে করিয়া খানিক লম্বা একটি ফুঁ দিলেন। অমনি ক্ষতস্থানটি বরফের মতো ঠাণ্ডা হইয়া গেল। তাহার কান্না থামিয়া গেল। ইহার পর আর মনেই হইল না তাহাকে বিষডাইয়া হুঁল ফুটাইয়াছিল।
এই লেখক তাহার মাতামহীর দ্বারা আরও অনেক সমস্যার অলৌকিক সমাধান পাইয়াছেন। দরবান শাহ্ (রহ.)-এর খাস দোয়ার বরকতে জয়নব বিবির হাত হইয়াছিল পরশপাথরতুল্য। তিনি যাহাকে যাহাই দিতেন তাহাই হইয়া উঠিত সুধাময়, বরকতময় এবং পরিত্রাণদায়ক। অসংখ্য মানুষও তাহার দ্বারা নানা রকম সংকটে পরিত্রাণ লাভ করিয়াছেন। তাহার কাছে ফরিয়াদ করিয়া পরিত্রাণ পান নাই- এমন কথা কখনো শোনা যায় নাই।
এই সব ঘটনাবলী ছাড়াও মহান অলী দরবান শাহ (রহ.)-এর কারামতের ব্যাপারে অনেক জনশ্রুতি রহিয়াছে। যাহা দায়িত্বশীল সূত্রের অসম্মতিহেতু বক্ষমান গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয় নাই।
মহান অলী হযরত নূরুজ্জামাল ওরফে দরবান শাহ্ (রহ.)-এর উসিলা ধরিয়া এখনও মানুষ বিপদ-আপদ হইতে উদ্ধার পাইতেছেন।
মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁহার বন্ধুগণের সম্মানে কিয়ামত পর্যন্ত উসিলা ধারণকারী মানুষের সংকটে উত্তরণ ঘটাইবেন।
আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন। আমিন।
-জামাল উদ্দিন আহমাদ